এই অধ্যায়ের শেষে শিক্ষার্থীরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলো শিখতে পারবে—
আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা বায়ু, পানি, লোহা, খাবার, বই ইত্যাদির মতো বিভিন্ন ধরনের বস্তু ব্যবহার করে থাকি। সেগুলো দেখতে বিভিন্ন রকম। কোনোটা গ্যাস, কোনোটা তরল, কোনোটা নরম, কোনোটা কঠিন, কোনোটা ভারী, কোনোটা হাল্কা, কোনোটা চকচকে–তোমরা বলে শেষ করতে পারবে না। পদার্থের এই ভিন্ন ভিন্ন রূপের কারণ হলো এগুলোর গঠন। যেহেতু পদার্থগুলোর গঠন একে অপরের থেকে ভিন্ন, তাই সেগুলো দেখতে ভিন্ন এবং সেগুলোর বৈশিষ্ট্যও ভিন্ন হয়। পদার্থগুলোর এই বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়।
আমাদের বহুল ব্যবহৃত কিছু পদার্থের গঠনের দিকে নজর দেওয়া যাক। এই ক্ষেত্রে, আমরা প্রথমে লোহা এবং তামা সম্পর্কে বলতে পারি। বিশুদ্ধ লোহাকে যতই ভাঙা হয় না কেন, সেখানে লোহা ছাড়া কিছু পাবে না। যে পদার্থ ভাঙলে সেই পদার্থ ছাড়া অন্য কোনো পদার্থ পাওয়া যায় না, তাকে মৌলিক পদার্থ বলে। লোহার মতো তামাও মৌলিক পদার্থ, কারণ এক টুকরা তামা যতই ভাঙা হোক না কেন আমরা সেখানে তামা ছাড়া আর কিছু পাব না। আমরা আমাদের শ্বাস প্রশ্বাসে যে অক্সিজেন গ্রহণ করি, সেটিও মৌলিক পদার্থ, কারণ এই গ্যাস যতই ভাগ করা হোক না কেন অক্সিজেন ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাবে না। লোহা এবং তামার মতো সোনা অথবা রুপা কিংবা হাইড্রোজেন বা নাইট্রোজেনও শুধু একটি উপাদান দিয়ে তৈরি এবং সেগুলোও মৌলিক পদার্থ বা মৌল ।
মৌলিক পদার্থকে ভাঙলে শুধু ঐ পদার্থকেই পাওয়া যায়। তোমরা এর মধ্যে জেনে গেছ যে পানিকে ভাঙলে আমরা অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেন এই দুটি ভিন্ন মৌলিক পদার্থ পাব। তার কারণ, পানি মৌলিক পদার্থ নয়, পানি যৌগিক পদার্থ। অর্থাৎ যে সকল পদার্থকে ভাঙলে দুই বা দুইয়ের অধিক মৌলিক পদার্থ পাওয়া যায় সেগুলোকে যৌগিক পদার্থ বলে। যৌগের ধর্ম, সেটি যে মৌলিক পদার্থ দিয়ে তৈরি হয়েছে, তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হতে পারে। পানি হচ্ছে তরল, কিন্তু অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেন হচ্ছে গ্যাস। পানির মতো লবণ আর চিনিও যৌগিক পদার্থ। লবণ তৈরি হয়েছে মৌলিক পদার্থ সোডিয়াম আর ক্লোরিন দিয়ে এবং চিনি তৈরি হয়েছে মৌলিক পদার্থ কার্বন, হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন দিয়ে।
লোহার গায়ে মরিচা ধরার কথা কে না জানে? গাঢ় ধূসর রঙের লোহার তৈরি রড (যা একটি মৌল) কিছু দিন বাইরে রাখা হলে, মরিচা নামে লাল বা বাদামি রঙের স্তর দেখা যাবে। আসলে বাষ্পের উপস্থিতিতে লোহার মৌল অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে মরিচা বা ফেরিক অক্সাইড নামে একটি যৌগ তৈরি করে।
এক গ্লাস পানিতে কিছু লবণ মিশিয়ে নাড়ো। এখানে লবণ ও পানির মতো দুই বা ততোধিক পদার্থের একত্রে অবস্থান করাকে মিশ্রণ বলে। লবণ আর পানি মিশ্রিত হলেও মিশ্রণের ভেতরে সেগুলো নিজ ধর্ম বজায় রাখে। অর্থাৎ একটি মিশ্রণে দুই বা ততোধিক ভিন্ন পদার্থ থাকে যেগুলো পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয় না, মিশ্রণের বিভিন্ন পদার্থ মৌল বা যৌগ হিসেবে থাকতে পারে। একইভাবে বায়ুও একটি মিশ্রণ, যেখানে নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন ডাইঅক্সাইড বা বাষ্প ইত্যাদির মতো বিভিন্ন পদার্থ বিদ্যমান । লক্ষণীয় যে লবণ আর পানির মিশ্রণে বিদ্যমান পানি এবং লবণ উভয় পদার্থ হলো যৌগ। অন্যদিকে, বায়ু এমন একটি মিশ্রণ, যেখানে মৌল ও যৌগ উভয় রকমেরই পদার্থ বিদ্যমান। নাইট্রোজেন, অক্সিজেন হচ্ছে মৌল কার্বন ডাইঅক্সাইড আর বাষ্প হলো যৌগ।
একটি মিশ্রণে দুই বা ততোধিক ভিন্ন পদার্থ থাকে, যেগুলো রাসায়নিকভাবে যুক্ত নয়। অন্যদিকে বিশুদ্ধ পদার্থ বলতে আমরা বোঝাই যে সেটি শুধু একটি উপাদান বা একটি যৌগ নিয়ে গঠিত। বিশুদ্ধ শব্দটি তার দৈনন্দিন অর্থ থেকে ভিন্ন উপায়ে এখানে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দোকানে যখন আমের ‘খাঁটি’ রস বিক্রি করা হয় তখন বোঝানো হয় সেখানে শুধু আমের রস রয়েছে, অন্য কোনো পদার্থ যোগ করা হয়নি। তবে আমের ‘খাঁটি’ রস রাসায়নিক অর্থে বিশুদ্ধ নয়। কারণ, এতে বিভিন্ন পদার্থ একত্রে মিশে থাকে।
পদার্থের ভৌত ধর্ম হলো এমন বৈশিষ্ট্য যা পদার্থের প্রকৃত রূপ পরিবর্তন না করেই পর্যবেক্ষণ করা যায়। রং, গন্ধ, ঘনত্ব, গলনাঙ্ক, স্ফুটনাঙ্ক এবং দ্রাব্যতা হলো ভৌত ধর্মের উদাহরণ। ভৌত ধর্ম একটি বিশুদ্ধ পদার্থ শনাক্ত করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন বিশুদ্ধ পদার্থের একটি নির্দিষ্ট গলনাঙ্ক থাকে; কিন্তু মিশ্রণের কোনো নির্দিষ্ট গলনাংক থাকেনা। কাজেই গলনাংক পরিমাপ করে বলে দেওয়া যেতে পারে একটি পদার্থ বিশুদ্ধ পদার্থ নাকি মিশ্রণ। যদি মিশ্রণের উপাদানগুলো আলাদা করার প্রয়োজন হয়, সেগুলো সাধারণত রাসায়নিক বিক্রিয়া ছাড়াই আলাদা করা যায়। কাজেই আমরা বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থকে এভাবে ভাগ করতে পারি :
মৌল: মৌলে শুধু এক ধরনের পরমাণু থাকে। যেমন: সোনা, রুপা, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন।
যৌগ: একটি যৌগে দুই বা ততোধিক পরমাণু একত্রে যুক্ত থাকে। যেমন: পানি, লবণ, কার্বন ডাইঅক্সাইড।
মিশ্রণ: একটি মিশ্রণে দুই বা ততোধিক ভিন্ন পদার্থ থাকে যেগুলো পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকে না। মিশ্রণকে আমরা তিনভাগে ভাগ করতে পারি।
বিজ্ঞানী ডাল্টন প্রথমে তার পারমাণবিক তত্ত্বে বলেছিলেন, পদার্থ পরমাণু নামে অত্যন্ত ছোট ছোট কণা নিয়ে গঠিত। নিস্ক্রিয় গ্যাসের পরমাণু ছাড়া অন্য পরমাণু সাধারণত মুক্ত বা স্বাধীন থাকতে পারে না, সেগুলো একে অপরের সঙ্গে মিলিত হয়ে অণু গঠন করে। পরমাণু হলো পদার্থের ক্ষুদ্রতম একক যা একটি মৌলের বৈশিষ্ট্য ধরে রাখে।
একটি অণু মুক্ত বা স্বাধীনভাবে থাকতে পারে। যৌগিক পদার্থের বেলায় একটি অণু হলো তার ক্ষুদ্রতম একক (কণা) যা ঐ যৌগের ভৌত এবং রাসায়নিক ধর্ম বহন করে। মৌলের ক্ষেত্রে, শুধু একই পদার্থের পরমাণু একত্র হয়ে অণু গঠন করে। উদাহরণস্বরূপ, দুটি অক্সিজেন পরমাণু একত্র হয়ে অক্সিজেন অণু গঠন করে।
আগের পাঠ থেকে তোমরা জানতে পেরেছ যে, এখন পর্যন্ত ১১৮টি মৌল আবিষ্কৃত হয়েছে, যার মধ্যে ৯৮টি প্রকৃতিতে পাওয়া যায় এবং বাকি ২০টি কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি মৌলের একটি নাম আছে। তাদের সংক্ষিপ্ত এবং সহজে প্রকাশ করতে আমরা সেগুলোর প্রতিটির জন্য প্রতীক ব্যবহার করি। সাধারণত প্রতীকগুলো মৌলের ইংরেজি বা ল্যাটিন নামের প্রথম একটি বা দুটি অক্ষর দ্বারা প্রকাশ করা হয়। একটি অক্ষর দিয়ে প্রতীক প্রকাশের ক্ষেত্রে বড় হাতের অক্ষর ব্যবহার করা হয়। দুটি অক্ষর দিয়ে প্রতীক প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রথমটি হবে বড় অক্ষরে এবং দ্বিতীয়টি ছোট অক্ষরে। যদি দুই বা দুইয়ের অধিক মৌলের ইংরেজি নামের প্রথম অক্ষর একই হয়, তবে একটি মৌলকে নামের প্রথম অক্ষর (ইংরেজি বর্ণমালার বড় হাতের দিয়ে প্রকাশ করা হয়। অন্যগুলোর ক্ষেত্রে প্রতীকটি দুই অক্ষরে লেখা হয়। পরমাণুর কিছু প্রতীক এবং সেগুলোর ইংরেজি বা ল্যাটিন নামের উদাহরণ দেওয়া হলো।
মৌলের নামকরণ (ইংরেজি নাম) | মৌলের নামকরণ (ল্যাটিন নাম) | ||||
মৌল | ইংরেজি নাম | প্রতীক | মৌল | ইংরেজি নাম | প্রতীক |
হাইড্রোজেন | Hydrogen | H | লোহা | Ferrum | Fe |
অক্সিজেন | Oxygen | O | তামা | Cuprum | Cu |
নাইট্রোজেন | Nitrogen | N | সোনা | Aurum | Au |
কার্বন | Carbon | C | রুপা | Argentum | Ag |
ক্লোরিন | Chlorine | Cl | সোডিয়াম | Natrium | Na |
ক্যালসিয়াম | Calcium | Ca |
আমরা শিখেছি যে দুই বা ততোধিক পরমাণুর সমন্বয়ে অণু তৈরি হয়। সংকেত থেকে কোন অণুতে কোন পরমাণু কতগুলো করে আছে, তা জানা যায়। একটি সংকেত আসলে একটি অণুর সংক্ষিপ্ত রূপ। অণু গঠনকারী পরমাণুর চিহ্ন দিয়ে একটি সংকেত লেখা হয়। এখন আমরা সংকেত লেখার নিয়ম এবং সংকেত থেকে কি বোঝা যায় তা জানব।
যেসকল মৌল সাধারণত, তরল ও কঠিন অবস্থায় থাকে, সেখানে অসংখ্য পরমাণু একসঙ্গে অবস্থান করে কিন্তু সেগুলো কোনো অণু গঠন করেনা। যার ফলে, সোডিয়াম, তামা এবং লোহার মতো এই জাতীয় মৌলের জন্য অণু হিসেবে কোনো সংকেত নেই। তবে কয়েকটি নিস্ক্রিয় গ্যাস ছাড়া বেশির ভাগ গ্যাসীয় পদার্থ দুটি মৌল একত্র হয়ে একটি অণু গঠন করে। যার ফলে, এসব মৌলের সংকেত হিসেবে সেগুলোর প্রতীকের সঙ্গে ছোট করে ‘২’ (2 as subscript) লিখা হয়। উদাহরণস্বরূপ, অক্সিজেনের সংকেত হলো ০, এবং নাইট্রোজেনের সংকেত হলো N,। তবে কিছু কিছু মৌল আছে যেগুলো কঠিন এবং তরল অবস্থাতেও নিজেদের দুটি পরমাণু একত্র হয়ে অণু গঠন করে। সেগুলোর সংকেতও ঠিক আগের মতো করে লিখা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ব্রোমিন (তরল) এর সংকেত Br ।
মৌল | প্রতীক | সংকেত |
হাইড্রোজেন | H | H2 |
নাইট্রোজেন | N | N2 |
অক্সিজেন | O | O2 |
ফ্লোরিন | F | F2 |
ক্লোরিন | Cl | Cl2 |
ব্রোমিন | Br | Br2 |
আয়োডিন | I | I2 |
পানি: যৌগের সংকেত থেকে আমরা জানি কোন কোন মৌলের পরমাণুর সমন্বয়ে যৌগটি গঠিত এবং ঐ যৌগে সেসব উপাদান মৌলের পরমাণুর অনুপাত কত। উদাহরণস্বরূপ, H,O সংকেত থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু এবং একটি অক্সিজেন পরমাণুর সমন্বয়ে একটি পানির অণু গঠিত হয়েছে।
কার্বন ডাইঅক্সাইড: আমাদের পরিচিত আরেকটি গ্যাস হচ্ছে কার্বন ডাইঅক্সাইড। আমরা শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় অক্সিজেন গ্রহণ করি, কার্বন ডাইঅক্সাইড পরিত্যাগ করি। বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড বেড়ে যাওয়ার কারণে গ্রিন হাউস ইফেক্ট-এর মাধ্যমে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে পৃথিবীর আবহাওয়ার ভয়াবহ পরিবর্তন হচ্ছে। কার্বন ডাইঅক্সাইডের অণু তৈরি হয় কার্বন এবং অক্সিজেনের পরমাণু দিয়ে। এই অণুতে একটি কার্বনের পরমাণুর সঙ্গে দুইটি অক্সিজেনের পরমাণু থাকে। কার্বনের প্রতীক C, অক্সিজেনের O, তাই কার্বন ডাইঅক্সাইডের অণুর সংকেত CO। কার্বন এবং অক্সিজেনের পরমাণু দিয়ে আরো একটি অণু তৈরি হয় সেই অণুটির নাম কার্বন-মনোক্সাইড। কার্বন মনোক্সাইডে একটি কার্বন পরমাণুর সঙ্গে একটি অক্সিজেনের পরমাণু যুক্ত হয় এবং তার সংকেত হচ্ছে CO। কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাসটি মোটামুটি নিরীহ একটি গ্যাস; কিন্তু কার্বন মনোক্সাইড অত্যন্ত ভয়ংকর বিষাক্ত একটি গ্যাস। কাজেই দেখতে পাচ্ছ, একই পরমাণু ব্যবহার করে খুবই সাধারণ অণু যেরকম তৈরি করা যায়, ঠিক সেরকম সম্পূর্ণ ভিন্ন খুবই বিষাক্ত গ্যাসের অণু তৈরি করা যায়।
লবণ: আমরা তরল হিসেবে পানি এবং বিভিন্ন গ্যাসের অণুর কথা বলেছি, এবারে আমরা কঠিন পদার্থের অণুর উদাহরণ দিই । আমরা সবাই প্রতিদিনই আমাদের খাবারের সঙ্গে লবণ ব্যবহার করি। লবণ তৈরি হয় সোডিয়াম (Na) এবং ক্লোরিন (Cl) এর পরমাণু দিয়ে। যেহেতু লবণের যৌগিক পদার্থে একটি সোডিয়াম এবং একটি ক্লোরিনের পরমাণু থাকে, তাই লবণের সংকেত হচ্ছে NaCl। তরল কিংবা গ্যাসে অণুগুলোর নির্দিষ্ট অবস্থান থাকে না, সেগুলো ক্রমাগত নড়াচড়া করতে থাকে। কিন্তু কঠিন পদার্থে অণুগুলো নির্দিষ্ট স্থানে আটকে থাকে। সে দিক দিয়ে লবণের একটি চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য আছে। লবণের অণুগুলো এলোমেলোভাবে না থেকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে কেলাস বা ক্রিস্টাল হিসেবে সাজানো থাকে।
সোডিয়ামের পরমাণুটি অত্যন্ত বিক্রিয়াশীল একটি ধাতু। খোলা বাতাসে রাখলে এটিতে আগুন ধরে যেতে পারে, আবার পানির সঙ্গে এটি ভয়ংকরভাবে বিক্রিয়া করে বলে সোডিয়ামকে সব সময় কেরোসিনে ডুবিয়ে রাখতে হয়। একইভাবে ক্লোরিনও খুবই বিক্রিয়াশীল এবং বিষাক্ত একটি গ্যাস, কিন্তু তোমরা সবাই জানো, এই সোডিয়াম এবং ক্লোরিনের পরমাণু মিলে যে লবণ বা সোডিয়াম ক্লোরাইড নামে যে যৌগিক পদার্থ তৈরি হয়, সেটি মোটেও বিক্রিয়াশীল বিপজ্জনক কোনো পদার্থ নয়। আমরা প্রতিদিন লবণ খাই এবং আমাদের শরীরের জন্য এটি খুবই প্রয়োজনীয় একটি পদার্থ। শুধু তাই নয়, লবণের কেলাসের ভেতর সোডিয়াম এবং ক্লোরিন এত শক্তভাবে আবদ্ধ থাকে যে হঠাৎ করে সোডিয়াম এবং ক্লোরিন মুক্ত হয়ে কোনো বিপদ তৈরি করতে পারে না৷
সোডা: আমরা এখন পর্যন্ত শুধু দুটি পরমাণু দিয়ে তৈরি অণুর উদাহরণ দিয়েছি। কিন্তু দুই থেকে বেশি পরমাণু দিয়েও অণু তৈরি হওয়া সম্ভব। যেমন কাপড় ধোয়ার সোডা সোডিয়াম, কার্বন এবং অক্সিজেনের পরমাণু দিয়ে তৈরি। কাপড় ধোয়ার সোডার বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে সোডিয়াম কার্বনেট এবং তার সংকেত হচ্ছে Na,CO,। কাজেই সংকেতটি দেখেই তোমরা অনুমান করতে পারছ, যে সোডিয়াম কার্বনেটে অণুর মধ্যে দুইটি সোডিয়ামের পরমাণু, একটি কার্বনের পরমাণু এবং তিনটি অক্সিজেনের পরমাণু থাকে ।
চিনি: আমরা সবাই মিষ্টি চিনির সঙ্গে পরিচিত। মিষ্টি খেতে ভালো লাগে বলে অনেক সময় বেশি চিনি খাওয়ার কারণে আমরা নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যায় পড়ি। চিনির অণুটি তৈরি হয়েছে কাৰ্বন (C), হাইড্রোজেন (H) এবং অক্সিজেনের (O) পরমাণু দিয়ে। চিনির সংকেত হচ্ছে C,H,O, এবং এটা দেখেই বুঝতে পারছ চিনির অণুতে ১২টি কার্বন, ২২টি হাইড্রোজেন এবং ১১টি অক্সিজেনের পরমাণু রয়েছে। এখন পর্যন্ত তোমাদের যে কয়টি অণুর উদাহরণ দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে এটি সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পরমাণু দিয়ে তৈরি!
হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড: তোমরা সবাই নিশ্চয়ই কমবেশি অ্যাসিড শব্দটি শুনেছ। লেবুর রস কিংবা ভিনেগারে দুর্বল অ্যাসিড থাকে এবং আমরা সেগুলো খাবারের মধ্যে ব্যবহার করি। এর পাশাপাশি কিছু অত্যন্ত শক্তিশালী অ্যাসিড আছে, যেগুলো লোহাকে গলিয়ে ফেলতে পারে, চামড়ার সংস্পর্শে আসলে সঙ্গে সঙ্গে চামড়াকে পুড়িয়ে ফেলতে পারে। সেরকম কয়েকটি অ্যাসিড হচ্ছে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড, সালফিউরিক অ্যাসিড এবং নাইট্রিক অ্যাসিড। এই অ্যাসিডগুলো খুবই সাবধানে ব্যবহার করতে হয় এবং কেউ ইচ্ছা করলেই সেটি বাজার থেকে কিনে আনতে পারে না।
কিন্তু একটি বিস্ময়কর ব্যাপার কি জানো? এই তিনটি অত্যন্ত বিপদজনক অ্যাসিডের ভেতর একটি অ্যাসিড কিন্তু তোমার নিজের অজান্তেই বহন করো এবং সারাক্ষণ ব্যবহার করে যাচ্ছ; সেটি হচ্ছে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড, একটি হাইড্রোজেন (H) পরমাণু এবং একটি ক্লোরিন (Cl) পরমাণু দিয়ে তৈরি, এই অ্যাসিডের সংকেত হচ্ছে HCl। তোমার পাকস্থলীতে খাদ্য পরিপাক করার জন্য সেখানে এই অ্যাসিড থাকে। যদিও এটি চামড়ার সংস্পর্শে এলে চামড়া পুড়ে যায়; কিন্তু পাকস্থলীর আবরণের কোনো ক্ষতি না করেই সেটি পাকস্থলীতে সংরক্ষণ করতে পারে।
মৌলিক পদার্থ, যৌগিক পদার্থ, অণু এবং পরমাণু সম্পর্কে বলার সময় শুধু পরিচিত পদার্থের উদাহরণ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এই পদার্থগুলো তোমাদের আশপাশে আছে এবং তোমরা এগুলো প্রতিদিন কিংবা নিয়মিত ব্যবহার করে থাকো। তোমরা যখন উপরের ক্লাসে যাবে, তখন মৌলিক পদার্থ, যৌগিক, পরমাণু, অণু এবং সেগুলোর ভেতরকার বিভিন্ন রাসায়নিক বন্ধন সম্পর্কে আরো নতুন নতুন বিষয় জানতে পারবে। যেমন তোমরা জানতে পারবে পানির অণুতে একটি অক্সিজেন পরমাণুর সঙ্গে সবসময় দুইটি হাইড্রোজেন পরমাণু থাকে। কেন দুইটির বেশি কিংবা কম থাকে না? একইভাবে তোমরা জানতে পারবে কেন লবণের অণুতে একটি সোডিয়ামের পরমাণুর সঙ্গে সব সময় একটি ক্লোরিনের পরমাণু যুক্ত হয়, বেশি বা কম কেন যুক্ত হয় না?
তোমরা যতই বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করবে, ততই প্রকৃতির এরকম নানা ধরনের বিস্ময়কর রহস্য তোমাদের সামনে উন্মোচিত হতে থাকবে।
১। পরমাণু মাত্রই মৌলিক পদার্থ কিন্তু মৌলিক পদার্থ মাত্রই পরমাণু নয়। কথাটি কি সত্যি? সত্যি হলে উদাহরণ দাও?